ভূল সিদ্ধান্ত নাজির হোসেন
১
আমি সবে দশম শ্রেনীতে পড়ি। ছাত্র হিসেবে খারাপ না, বরং ভালো। ক্লাসে প্রথম হতে না পাড়লেও দ্বিতীয় তৃতীয়’তে সর্বদাই আমার স্থান থাকে। আমার একজন খুব প্রিয় মানুষ আছে। সে আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে, মানে নবম শ্রেণীতে। আমরা দু’জন দুজন’কে অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমার প্রিয় মানুষটা আবার অনেক মেধাবী। মুখস্থ বিদ্যায় পটু। সায়েন্সের স্টুডেন্টরা সাধারণত একটু মেধাবী হয়। আমিও অবস্য সায়েন্সের ছাত্র। মেয়েরা মেধাবী হওয়ার কারণ হলো, তাদের শুষ্ক মস্তিষ্কে খুব সহজেই মনে রাখতে পারে অনেক কিছু। কাজ টাজ না থাকায় যখন তখন বইয়ের গভিরে ডুবে যেতে পারে।
আমার কথা আর কী বলবো। আমি’তো বইখোর সারাক্ষণ নানান সব বই নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু ইদানিং আমাদের দুজনের মদ্ধে যেনো একটা পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে। সারাক্ষণ হারানোর ভয়টা মনের মদ্ধে গেথে যাচ্ছে। অনেক আবেগে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। একদিন রাত্রে আমার সাবকনসাসমাইন্ড যেনো সারাক্ষণ ভাবাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিয়ে করে ফেলি। বুঝতেই পারছেন বিয়ে করতে হলে কিভাবে বিয়েটা করতে হবে। এই বয়সে তো আর দু’জনের পরিবার কখনোই রাজি হবে না। নাঃ বরং একবার বাবা/মা’কে বলে দেখলে মন্দ হবে না হয়তো। মা’কে বললাম ‘
'মা আমি বিয়ে করবো’
মা বললো,
'দিবো এক কসি থাপ্পর। পাগল হয়েছিস নাকি, এটা তোর পড়ালেখার বয়স। বিয়ের বয়স নয়। যা ভাগ এখান থেকে। যে পিচ্চি বাচ্চা, বলে নাকি বিয়ে করবে আবার।'
আমি পড়ি দশম শ্রেণীতে, এখনো নাকি আমি পিচ্চিই রয়ে গেছি মায়ের কাছে। নাঃ বুঝতে পেরেছি, এভাবে কাজ হবে না। পালিয়ে বিয়ে করতে হবে। এটাই ভালো হবে আমাদের দুজনের জন্য।
আজকে আমি অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। ফজরের নামাজ পড়ে আর কোনো পড়তে বসিনি। বরং আজ ভোরে হাটছি। হাটলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। আজকের সকালটা আমাকে অনেক শান্ত লাগতেছে। স্কুল, সকাল সাতটায় যাইতে হয়, তাই আজ আর হাঁটা হলো না। বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সোজা স্কুলে রওয়ানা দিলাম।
আজকে আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। ক্লাসের মদ্ধে খুবই বিরক্ত লেগেছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো আজ আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা হয়নি। সে নাকি আজ স্কুলেই আসেন।
২
- 'স্যার আসতে পারি?'
- না, তুই ওখানে দাড় হয়ে থাক। আজ তুই আমার ক্লাস করতে পারবি না।
- কেনো স্যার?
- ঘড়িতে দেখতো ক’টা বাজে।
- স্যার মাত্র আট’টায় ত্রিশ।
- দিবো এক কসি থাপ্পর, আটটায় ত্রিশ এটা আবার মাত্র। কতক্ষণ আজ লেট করে এসেছিস?
- ত্রিশ মিনিট স্যার
- বাকি দশ মিনিট ওখানে কান ধরে থাক।
স্যারের হুকুম। না মেনে উপায় নেই। সুতরাং মানতেই হচ্ছে। ক্লাসের মদ্ধ্যে সকলের সামনে কান ধরে থাকলাম পুরো দশ মিনিট। আমি চাইলেই অজুহাত দেখাতে পারতাম। কিন্তু তা করলাম না। এমনিতেই তেই মনটন ভালো না। মানুষের হাত হলো মূলত দু’টা। অজুহাত ও মূলহাত। এটি একটি কথার কথা মাত্র।
*****
স্কুল ছুটি হলো ঠিক একটায় বিশ মিনিট। আমি তো ছুটি হওয়া মাত্রই রওয়ানা দিলাম আমার প্রিয় মানুষটার কাছে তার স্কুলে। ভাগ্যিস আজ সে স্কুলে এসেছে। তারসাথে দেখা হলো স্কুল ক্যাম্পাসে। আমি পিছন থেকে গিয়ে ‘কুয়ু’ করে উঠলাম। সাথে সাথে চমকে উঠলো সে।
আমার প্রিয় মানুষটা বললো,
- এই তুমি তো আমায় চমকে দিছিলা। এভাবে কেউ কুয়ু করে। তুমি কি কুকিল পাখি নাকি যে কুয়ু করবে।
আমি বললা,
- মনে করো আমি তোমার কুকিল পাখি। আচ্ছা এখন বলো তুমি কেমন আছ?
- আমি ভালোই আছি, তুমি কেমন আছো।
- আলহামদুলিল্লাহ আমিও মোটামুটি। তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
- বলো, তবে তাড়াতাড়ি। এখুনি আমার নানা আসবে।
- আচ্ছা আমরা দু’জন যদি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি তাহলে কেমন হয় বল তো।
- পালিয়ে বিয়ে করবে। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমি বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে করবো। সবাই আনন্দ করবে। আহ! কি মজা হবে।
- তুমি জানো আমি তোমার জন্য অনেক চিন্তিত। সারাক্ষণ শুধু তোমার চিন্তায় কিছুই করতে পারি না। তোমাকে হারানোর ভয়টা মনের মদ্ধ্যে গেথে যাচ্ছে।
- তাহলে তুমি কি এখন চাচ্ছ আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। যদি ভালো হয় তাহলে তাই কর। কিন্তু যা করার ভেবে চিনতে করবে। পড়ে যেনো সমস্যায় পড়তে না হয়। আচ্ছা আমরা যদি পালিয়ে যাই, তাহলে তো আমাদের টাকার প্রয়োজন হবে। সেটা কিভাবে যোগাবে।
- সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি কিছু টাকা এতোমদ্ধেই জমিয়ে রেখেছি।
- আচ্ছা তাহলে আমি এখন বাসায় যাই, চিন্তা করতেছে হয়তো সবাই।
- ঠিক আছে যাও, আমি তোমাকে জানাবো।
আমি ভাবতেও পারিনি যে আমার প্রিয় মানুষটা এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। যাক বাবা বাচা গেলো এখন আমাকে একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে হবে যেটা আমাদের জন্য পালিয়ে যাওয়ার হবে উত্তম একটি দিন।
৩
আচ্ছা আসলেই কি পালিয়ে বিয়ে করাটা উচিৎ হবে। একটু ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো। পরবর্তীতে কি হবে? নাঃ অতো ভাবা টাবার সময় নেই, যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে সেটা।
দিন ঠিক করলাম। ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটাতে আমাদের দুজনের স্কুল বন্ধ থাকবে। তবে স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। আমরাও এই ফাকে পালিয়ে যাবো এই দিনটাতেই দুজনে।
স্কুল ছুটি হলো। আমি আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা করলাম আর আমার সমস্থ প্লান খুলে বললাম।
আমি বললাম;
- শুনো আমরা ২৬শে মার্চ পালিয়ে যাবো বিয়ে করতে তুমি ওই দিন তোমার কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরে নিয়ে আসবে স্কুলে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো স্কুল ক্যাম্পাসে। বুঝেছো...
- ঠিক আছে। আচ্ছা তুমি পালিয়ে যাওয়ার জন্য ২৬শে মার্চকে কেনো বেচে নিলে?
- ওমা! তুমি জানো না, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। মনে করো আমি আমাদের ভালোবাসার স্বাধীনতার ঘোষণা দিলাম। ওই দিন আমাদের স্কুলের ক্লাস বন্ধ থাকবে। তুমি স্কুলের কথা বলে আসবে। ভুলেও স্কুল ড্রেস পড়ে আসবে না।
- তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। এতো বুদ্ধিদীপ্ত মাথা নিয়ে থাকো, আগে বলোনি তো।
- আচ্ছা তুমি এখন যাও। রেডি থেকো কিন্তু। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
ডিসিশন ফাইনাল, বিয়েটা তাহলে পালিয়েই হচ্ছে। তাও আগামী ২৬শে মার্চে। নিশ্চিত আমাদের বিজয় হবেই। আমরা এই বিয়েতে বিজয়ী হবোই। মনের মদ্ধ্যে যেনো ছন্দের আবির্ভাব ঘটে গেলোঃ
পালিয়ে করবো বিয়ে
কষ্ট যাবে দূরে
থাকবো না আর একলা ঘরে
সাথে থাকবো দুজন মিলে
থাকবো মোরা সুখে
নাঃ আর কালক্ষেপন করা যাবে না। হাতে আছে দু’দিন, এই দুদিনে সব কিছু ঠিক করতে হবে। পালিয়ে গিয়ে থাকবো কোথায়, তা তো এখনও ঠিক করাই হলো না। টাকার চিন্তা তো বাদই দিলাম, হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে মনে হলো আগে কাজি অফিসে বিয়ে করব, তারপর ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে উঠবো। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ধরে নিলাম এটা একটা এডভেঞ্জার, লং এডভেঞ্জার।
৪
দু'দিন কেটে গেলো। আজকে আমার অনেক খুশি খুশি লাগতেছে। কারণ আজ ২৬শে মার্চ। একদিকে স্বাধীনতা দিবস, আর আমাদের জন্য পালিয়ে যাওয়া দিবস।
আমি ব্যাগ গুছিয়ে প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে সব নিলাম, সাথে কিছু হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটা বইও নিলাম। আমার আবার বই পড়ার নেশা অনেক। বইপোকা বলা যায়, কিন্তু আমি নিজেকে বইপোকা বলি না, বলি বইখোর।
মা’কে স্কুলের কথা বলেই রওয়ানা দিলাম স্কুলে। কিন্তু আমি আমার নিজের স্কুলে না গিয়ে গেলাম আমার প্রিয় মানুষটার স্কুলে। পায়ে হেটে যেতে সময় লাগলো মাত্র দশ মিনিট। আমাদের দু’জনের দেখা হলো স্কুলের ক্যাম্পাসে। আমার প্রিয় মানুষটা ব্যাগ ভর্তি করে ফেলেছে। জানিনা কিভাবে এতোকিছু ম্যানেজ করলো। কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে পাচ-ছ’শত টাকা জমানো ছিলো তাই নিয়ে এসেছে আমার প্রিয় মানুষটা। এসেই আমার হাতে ধরে দিলো টাকাগুলো।
আমি বললামঃ
- এতো দেরি হলো যে আসতে?
- দেরি হবে না মানে, অনেক কষ্টে এসেছি। কাপড়-চোপড় খুজতে সময় লাগবে না বলো। এখন বলো তুমি কি পরিকল্পনা করলে।
- আমরা আগে বিয়ে করবো, আর বিয়েটা ঢাকায় গিয়ে করবো। তারপর ঘুরতে যাবো।
- শ্রীমঙ্গলে।
- এতো টাকা আছে তোমার কাছে?
- হু আছে, আমি জোগাড় করেছি। আজ সন্ধায় বাসে উঠবো আমরা। এখন বাজে তিনটা। ছ’টায় বাস ছাড়বে ঢাকার উদ্যেশে। আর মাত্র তিন ঘন্টা।
আমাদের এখন তো কোনো মতেই এই তিন ঘন্টা কাটাতে হবে। তাই স্কুলের অনুষ্ঠানেই থেকে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলো চার’টায় ত্রিশ মিনিটে। এরই মধ্যে কেটে গেলো এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট। সারে চারটা পর্যন্ত স্কুলেই থেকে গেলাম। অবশেষে পাঁচটায় ত্রিশ মিনিটে বাস স্থানে রওয়ানা দিলাম। এই মূহুর্তে আমার পেটের মদ্ধ্যে ঢোল বাজানী শুরু হয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি আমাদের কোনো পরিচিত মানুষ দেখে ফেলে। ভয়ে ভয়ে অনেক কষ্টে বাস স্টপে পৌছে গেলাম।
বাস ছেড়ে দিলো কাটায় কাটায় ছয়’টায়। অবশেষে সস্থি পেলাম। আর কোনো চিন্তা থাকলো না। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। কিছুক্ষনের মদ্ধ্যেই দুজনের চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো। ডুবে গেলাম গভির নিদ্রায়।
ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে দেখি বাজে রাত একটা। ছ’ঘন্টা ঘুম হলো বাসের মদ্ধ্যেই বাস ঢাকা জেলায় প্রবেশ করেছে। হয়তোবা আধঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌছে যাবো আমাদের গন্তব্যস্থানে।
****
৫
অবশেষে তাই হলো কেটে গেলো পয়তাল্লিশ মিনিট। পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় বাস ব্রেক কসলো। মানে আমরা পৌছে গেছি ঢাকায়। অবশ এতো বড় ঢাকার কিছুই চেনা নেই আমার। আমি ডেকে তুললাম আমার প্রিয় মানুষটাকে। নেমে পড়লাম বাস থেকে। এখন অনেক রাত। এতো রাত্রে আশা করিনি যে কোনো রিকশা কিংবা অটো পাবো।
-এই ভাই বনানী যাবেন?
-হ যামু, দুইজন জাইবেন নাকি?
-হু, ভাড়া কত দিতে হবে?
-পঞ্চাশ ট্যাহা। অনেক রাইত অইছে তো হেইল লাইগা একটু বেশি। না অইলেও ত্রিশ মিনিটের রাস্তা।
কোনো কথা না বলে আমরা দুজন উঠে পড়লাম। রিকশাওয়ালাকে দেখে বেশ ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। বয়স আনুমানিক চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ হবে। রিকশাওয়ালা বললোঃ
-আপনেরা কোনেত্তে আইছেন?
-আপনে জেনে কি করবেন।
-না মানে, এমনি কইলাম।
আমার প্রিয় মানুষটা বললো
-চাচা আমরা রংপুর থেকে এসেছি।
-এইহানে কি তোমাগো কোন আত্তীয়ের বাড়ি আছে?
আমি বললামঃ
-Why Are You Tell Lot Of Question? (আমি রেগেমেগে বললাম)
আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে বললোঃ
-তুমি আবারো ইংরেজি বলতেছো মানে, তোমাকে না বলেছি ইংরেজি কম বলতে।
-দুঃখিত। মুখ ফুসকে বেড়িয়ে এসেছে
আমার উপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আমি কোনো ইংরেজি বলতে পারবো না আমার প্রিয় মানুষটার সামনে। আমি শেষ পর্যন্ত রিকশাওয়ালাকে বলেই ফেললামঃ
-আমরা বিয়ে করতে এসেছি। বুঝতেই পারছেন পালিয়ে বিয়ে।
-ও’ বুঝেছি, আইচ্ছা তোমাগো একটা গল্প কই শুনবে? আমার জীবনের গল্প।
-এই মূহুর্তে আপনার গল্প টল্প শোনার আমাদের কাছে টাইম নাই, আপনি আমাদের দ্রুত নিয়ে যান। রাত অনেক। আর শুনেন কোনো একটা কাজি অফিসের বাড়িতে নেমে দিয়েন। (কড়াভাবে বললাম)
-যে আইচ্ছা (বলেই রিকশাওয়ালা চুপচাপ থাকল)
মধ্যরাত। রাস্তায় শুধু আমাদের রিকশাটা ছাড়া অন্য কোনো রিকশা চোখে পড়ে না। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত পুরো রাস্তাটা। হালকা বাতাস ভেষে আসছে। শীতল করে দিচ্ছে পুরো শরীর। এই সময়টাতে ঠান্ডা গরম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হালকা ঠান্ডা বললে ভুল হবে না হয়তো।
হঠাত করে রিকশা থামলো। মনে হয় আমরা এসে গেছি। এই মূহুর্তে যে জায়গায় রিকশাটা থেমেছে সেখানে আশপাশ কোনো বাড়ি চোখে পড়ে না। তবে সামনে একটা দু’টা পুরোনো বাড়ি রয়েছে। হয়তো সেগুলো এখন ব্যবহত হয় না। তবে চাদের আলোয় বাড়িগুলো বেশ দেখাচ্ছে। রিকশাওয়ালা বললোঃ
-বাবা তোমরা এইহান থাহো আমি এহুনি আইতাছি।
-কোথায় যাবেন আপনি? আমাদের এই ভুতুড়ে যায়গায় রেখে।
-এক এর চাপ দিছে, এক করতে যাচ্ছি। এহুনি আইমু।
-আচ্ছা যান, তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু।
ভাবলাম কি আর হইলো কি। লোকটা এক এর কথা বলে যে কোথায় উধাও হয়ে গেলো রিকশা সহ আমাদের এখানে রেখে। এখনো আসতেছে না।
৬
এতোমদ্ধ্যে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলো, এখনো রিকশাওয়ালার কোনো খোজই নেই। এক করতে তো এতো সময় লাগার কথা না। বুঝেছি! এই শালায় আমাদের এই ভূতুড়ে পরিবেশে রেখে পালাইছে। শালা রিকশা’র হেডলাইট টাও জ্বালায় রাখে নি।
হঠাত করে আমার প্রিয় মানুষটা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো, বললো;
-“আমার খুব ভয় করতেছে।
আমি বললামঃ
-“কোনো ভয় নেই, তুমি কোনো চিন্তা করো না’তো। আমার হাত ধরে থাকো।
এতোমদ্ধ্যে আমারো ভয় লাগতে শুরু করেছে। গভির রাত, হালকা চাদের আলো। কোথাও কেউ নেই। একদম অপরিচিত একটা জায়গা। যদি কিছু ঘটে যায় আবার। দেশে তো আবার ডাকাত, অসৎ মানুষের অভাব নেই। এখন আমার বুকের মদ্ধ্যে অসস্থির ভাব চলে এসেছে। ভয় লাগতে শুরু হয়েছে।
হঠাত করে পাশের একটা পুরোনো বাড়ি থেকে কী জেনো শব্দ করলো। শব্দ করার সাথে সাথে আমার প্রিয় মানুষটা ওরে বাবা ভূত বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হয়তোবা ভয় পেয়েছে। মেয়েরা সাধারণত অল্প কিছুতেই ভয় পেয়ে যায়।
বাড়িটা আনুমানিক একশত-দু’শত বছরের পুরোনো হবে হয়তো। আমিও মনে মনে ভয় করলাম একটু। কিন্তু তা প্রকাশ করলাম না। আমার প্রিয় মানুষটার মতে কোনো ভুত টুত হবে হয়তো। আমি আবার ওসব ভূত-টুত বিশ্বাস করি না।
ভূত সম্পর্কে আমার জীবনের একটা গল্প বলা যাক। একবার আমি আমার ভাই সহ শ্রীমঙ্গলে যাই, শ্রীমঙ্গলে আমার ভাইয়ের শশুর বাড়ি। আমার ভাইয়ের শালীর বিয়ের দিন ভাইয়ের নিজের শালা বউকে ও তার নিজের শালীকে নিয়ে আসে চট্রগ্রাম থেকে। বিয়ের দ্বিতীয় দিন ভাইয়ের শশুর বাড়িতে থাকার যথেষ্ঠ পরিমানে যায়গা না থাকায় তার শালা বউকে ও তার ছোট শালীকে নিয়ে আমার ভাবির বোনের বাড়িতে যায় থাকতে। সেই রাতেই ঘটে যায় ভূতুরে কাহিনি। আমার ভাইয়ের শালার শালীকে নাকী ভূতে ভর করেছে। কারণ সে আবল-তাবল বলতে শুরু করেছে, রাত তখন অনেক হয়েছিল । আনুমানিক বাড়টা বেজে গিয়েছিল। এ বাড়ি থেকে আমরা খবর পেয়ে ছুটে যাই, আমাকে তো নিতেই চায় না। আমি ছোটো মানুষ বলে। তবে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কানে তেল মেখে। যে ভূত ভর করেছে সে ভূত আর যে সে ভূত নয়, স্বয়ং আমার ভাইয়ের বড় শালীর স্বামীর আত্মা। আমার ভাইয়ের শালীর স্বামী একটি রহস্যময় কারণে মারা যায়, তা না বলাই ভালো। সবাই রাত্রে ঘুমাতে পারবে না হয়তো।
আমি ভাইয়ের শালার স্ত্রীর কথা শুনে হতবাক। তার বোনকে নাকি আত্মা ভর করেছে। তার বোনের বয়স আনুমানিক আট-নয় হবে। নাম মিনারা, বেশ সুন্দর নাম। আমি বললামঃ
-আত্মা বলতে কিছু আছে নাকী। এসব ভূত টুত বলতে কিছু নেই। আছে শুধু জিন, পরী, কিন্তু ভূত নয়।
-ভূত নেই, একদিন রাত্রে এই গ্রামের বাথরুমে ডুবে দিবো তখন বুঝবা ভূত কেমন নেই।
ভাইয়ের শালার স্ত্রীর কথা শুনে আমার নিজের অজান্তেই হাসি চলে এলো।
রাত অনেক। তাই না ফিরে ওখানেই থেকে গেলাম আমরা কয়েকজন। আমার ভাই, তাওয়াই, আমি আর কয়েকজন মিলে মাটির বাড়িতে থেকে গেলাম। শোয়া মাত্র আমার চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো, মানে রাজ্যের ঘুম আমার শুরু হয়ে গেলো। সেই রাত্রে আমি এমন সপ্ন দেখেছি যা আমাকে বিশ্বাস করতে বাদ্ধ করেছে যে এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। সপ্নটা দেখার পর আমি আর ঘুমাতে পারিনি। খুবই ভয় পেয়েছিলাম। ফজরের আজানের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। সপ্নটা অনেক ভয়ের ছিলো। তোমাদের বললে হয়তো ঘুমাতেই ভয় পাবে। তাই বললাম না। অবস্য সপ্নের কথা না বলাই ভালো।
আমার ভাইয়ের শশুর একজন ঈমানদার মানুষ। তিনি কিছু নির্দিষ্ট দোয়া দরুদ পড়ে ফু দিয়েছেন। সাথে সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তার মতে এই বাড়িতে কিছু জীন/পরী দখল করার চেষ্টা করতেছিলো। কারণ কয়েকদিন ধরে বাড়িটা ফাকা ছিলো। পাশেই হিন্দু পল্লি। তবে একদিকে হিন্দু আরেকদিকে মুসলিম। চা বাগানে ভরপুর, পাহাড়ী চা, রাবার বাগান, বিশাল বন, বানরের কোনো অভাব নেই। গ্রামের নাম দূর্গানগর।
তার মেয়ের বিয়ের কারণে এই বাড়ির সবাই শশুর বাড়িতে ছিলো। আমারও তাই ধারণা। এটাই হবে মূল কারণ। ভূত বলতে কিছু নেই। শুধুমাত্র জিন পরিরাই আছে। যা আল-কুরআনেও উল্লেখ আছে। পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত।
*****
৭
আমার প্রিয় মানুষটা সত্যি অনেক ভয় পেয়ে গেছে। হঠাত করে সেই পুরোনো বাড়ি থেকে একটা কন্ঠ ভেষে এলো। কন্ঠটা অনেকটা মানুষের মতো। কিন্তু বেশ ভয়ংকর।
-কে হে বতস তোরা, এদিকে আয়।
আহ ভূত আবার এতো শান্ত ভাবে কথা বলে। আমি হতবাক, বুকে ভয় তো আছেই। আমি বললামঃ
-কে আপনি, ভূত?
-তা হলে বলেন তো আমাদের মনের কথা কী?
-তোমরা দুজন সেই রংপুর থেকে এসেছ পালিয়ে বিয়ে করতে, তাই না?
-হু, একদম ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন। এটা ক্যামনে সম্ভব।
-ওই যে বললাম না, আমরা ভূতেরা সব কিছুই জানি। তুমি যে ভূত বিশ্বাস কর না তাও জানি।
.
আমার প্রিয় মানুষটা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখছে, মনে হচ্ছে খুবই ভয় পেয়েছে। সে আমাকে বললোঃ
-আমার খুব ভয় করতেছে। চলো আমরা দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই।
-নাঃ, এই মূহুর্তে পালিয়ে গেলে ভূত বেটায় খেয়ে ফেলবে। তুমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখও। এখন বাজে তিনটা ফজরের আজান হলেই ভূত আর থাকতে পারবে না। এভাবে কথা বলে সময় কাটাতে হবে।
-যদি আমাদের মেরে ফেলে ভূতটা। আহ, অনেক ভয়ংকর ভূতটা।
-তুমি ভয় করো নাতো। ভয় করলে তোমাকে আগে খেয়ে ফেলবে।
ভূতটা আবার বলে উঠলোঃ
-কি বলছ তোরা ফিসফিস করে, আমি কিন্তু সব শুনছি। বলবো?
-না, প্লিজ বলবেন না এগুলো।
-এবার শুনো তাহলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে, আমি তোমাদের আমার জীবনের একটা দুঃখের গল্প বলব। শুনবে তো?
এই ব্যাটা আবার গল্প বলবে। ভূতের জীবনের কী কখনো গল্প হয়, তাও দুঃখের গল্প। আমি বললামঃ
-আচ্ছা বলেন আমরা দুজন শুনতেছি। একটা বড় গল্প বলবেন যেনো এক ঘন্টা লাগে শেষ হতে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনোঃ
তোমাদের মতো আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি একটা ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যার ফল এখন ভুগতেছি।
আমি বললামঃ
-আপনি আবার ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
-জী, আমিও একবার ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যখন আমি ছোট ছিলাম।
-আপনি না ভূত, আপনি আবার ছোট ছিলেন।
-আমি যখন মানুষ ছিলাম তখনকার কথা বলতেছি, -এখন কোনো কথা না বইলা মনোযোগ দিয়ে শুনো।
-জী, আচ্ছা।
ভূতটা তার জীবনের গল্প শুরু করলো, তিনি বলতে লাগলেনঃ
আমি যখন দশম শ্রেনীতে উঠি তখন সপ্তম শ্রেনীর এক মেয়ের সাথে আমার ভালোলাগা শুরু হয়, অতঃপর ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। আমি ছাত্র হিসেবে কখনোই ভালো ছিলাম না। টেনে টুনে পাস করতে পারলেই আমি যেনো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। কোনো মতো পাস করাটাই ছিলো আমার অভ্যাস। আমি সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম, ঘুড়ে বেড়াতাম। স্কুল টাইমে স্কুলে যেতাম লেট করে, বন্ধুদের সাথে লাস্ট বেঞ্জে বসতাম, গল্প করতাম, স্যার পড়া ধরলে পারতাম না। সারাক্ষণ স্টাইল নিয়ে বেড়াতাম। সাধারণত Smart আমরা বলি তাদের যারা ভালো পোষাক পড়ে, বিএমডব্লিউ নিয়ে ঘুড়ে। ক্লাসের সময় লাস্ট বেঞ্জে বসে, স্যার পড়া ধরলে পড়তে পারে না। এটাকেই আমরা মূলত স্মার্টনেস বলি। প্রকৃত পক্ষে এটা Smart নয় বরং বখাটে। কেনোনা Smart এর এটা প্রকেত অর্থ নয়। Smart এর পূর্ণ রুপই হলো S=Specific M=Measurable A=Achievable R=Realistic T=Timeframe.
যারা কোনো কিছু শেখার চেষ্টা করে, সময়মত কাজ সম্পূর্ণ করে। যাদের সময় ব্যবহার করতে পারে না। তারাই প্রকেত পক্ষে Smart. সময়কে ব্যবহার করতে না পারলে সময় বরং আমাদের ব্যবহার করবে।
যাইহোক, আমি আর আমার প্রেমিকা মিলে সিদ্ধান্ত নেই পালিয়ে যাওয়ার। ঠিক তোমাদের মতো, তবে একটু ভিন্ন। এবং সময় নির্ধারণ করে পালিয়ে যাই। যদিও সামনে ছিলো এসএসসি পরিক্ষা। কিন্তু সে টেনশন আমার একদমই ছিলো না। ব্যাপার না, হয়ে যাবে। অর্থাৎ খাও দাও ফূর্তি করো, জীবন’টা মস্তবড়। আমরা পালিয়ে যাই, কিন্তু রাত্রে আবার বাদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে হয়। তবে কয়েকদিন পর আবারো আমরা একই কাজ করে ফেলি, তাতেও ফিরে আসতে হয়, কারণ কোন কাজিই আমাদের বিয়ে পড়াতে চাইছিল না। কেউ রিস্ক নিতে চান না। এরপর বাদ্ধ হয়ে আমার পিতা মাতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাছাড়া যে আর কিছুই করার ছিল না। অল্প বয়সে বিয়ে, বুঝতে পারছো বাল্য বিবাহ। ছেলে এসএসসি এখনো দেয় নি, আর মেয়ে কেবলে সপ্তম পড়ে। তেরো থেকে ষোল বছর।
কিন্তু একদিন যেনো নেমে এলো এক অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন। অন্ধকারাচ্ছন্ন বলতে বিপদময়। যা খুবই কান্নাদায়ক। বলেই ঢুকরে ঢুকরে কানতে লাগলো ভূতটি। আমি বললাম,
-কি জন্য দিনটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো বলবেন কি একটু।
ভূতটা বললোঃ
-আমার বাবার মৃত্যু হয় ওই দিন, আমার বাবা তখনো ছেলে মানুষ, বয়স আনুমানিক চল্লিশ-পয়তাল্লিশ। হয়তবা আমার চিন্তাই তার মৃত্যুর আসল কারণ। হয়তোবা নয় বরং হয়েই। সারাদিন যেনো আর আমার কান্না কেউ থামাতে পারে না। খনিকের সুখের জন্য সম্পূর্ণ জীবনটাই যেনো বিষন্নতায় এবং এক কঠিন বিপদে ফেলে দিলাম। এ ভূল সিদ্ধান্তটা মোটেও ছোট-খাট নয়, বরং অনেক বড় ভূল সিদ্ধান্ত। এ বয়সে আমাকে কে কাজ দিবে, আমার তো সে যোগ্যতাও নেই। যার ফলে শেষমেশ আমাকে রিকশা চালাইয়া খাইতে হচ্ছে। আমি এখন এক রিকশাওয়ালা।
হায়রে আমি যদি আজ ঠিকমতো পড়ালেখা করতাম তাহলে এমনটা হত না। আমি পড়ালেখায় দূর্বল ছিলাম কারণ আমি ভালো করে পড়ালেখা করি নাই। আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে সুস্থ সবল মস্তিষ্ক দিয়েছে, কিন্তু আমি তার যথাযথ ব্যবহার করি নাই। আমি সবসময় ভেবেছিলাম আমার দ্বারায় এসব পড়ালেখা হবে না। আল্লাহ্ তায়ালার এতো মহান সৃষ্টি’কে তুচ্ছ ভেবেছি, আমি বড় পাপ করেছি। যার ফল এখনো আমাকে ভুগতে হচ্ছে।
অনূরুপ তোমরাও যদি একই ভূল সিদ্ধান্ত নাও তাহলে কিন্তু তোমাদেরও ভব্যিষতে এক কঠিন পরিস্থিতে পড়তে হবে। আমি জানি তোমাদেরও একটা বড় সপ্ন আছে। তোমরাও ভাবো যে ভবিষ্যতে একজন বড় প্রকৌশলী কিংবা বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু সেই সপ্নকে যদি বিপর্যয় দাও তাহলে কিন্তু এর থেকে ভয়ংকর আর কিছুই হবে না। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, স্বাধীন হতে চাইতেছো। কিন্তু তোমরা জানও না যে ২৬শে মার্চের পর আরও নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে লাখও মানুষকে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি আমরা।
৮
আমরা সত্যি অনেক ভুল করে ফেলেছি পালিয়ে এসে, মোটেও এটা আমাদের করা উচিৎ হয়নি। আমরা দু’জন খুবই ভূল করেছি। আসলেই আমাদের একটা সপ্ন আছে, বড় প্রকৌশলী গবেষক হওয়ার সপ্ন। ওহ, আল্লাহ্ বেচে গেলাম। ভাগ্যিস ভূত চাচা'টা আমাদের বাচিয়ে দিলো। আর কখনোই এরকম ভূল সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমাদের উচিৎ হবে না। এটা ভয়ংকরের চেয়েও ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা করতে গিয়ে সারা জীবনটাই পরাধীন হয়ে থাকতে হতো আমাদের। কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবসময় ভাবতে হয়, পরে কি হবে।
আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে বললোঃ
-'একদম ঠিক বলেছ তুমি। এখন আমাদের উচিৎ হবে বাসায় চলে যাওয়া। আমরা অনেক বড় ভূলের হাত থেকে বেচে গেলার। যতদিন আমরা প্রতিষ্ঠিত হবও না, ততদিন আমাদের মধ্যে কোনো বিয়ের নাম থাকবে না।'
চতুর্দিকে আজান হচ্ছে, এই মূহুর্তে ভূত চাচা’টা বললোঃ
-তাহলে তোমরা কি এখনি যাবে। বাজান তোমরা বরং আজ আমাদের বাসায় চলো। কাল বরং আমিই তোমাদের পৌছে দিবো বাসস্টানে।
আমি বললামঃ
-আপনি না ভূত। আপনি কিভাবে আমাদের পৌছে দিবেন।
ভূতটা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এলো, বললোঃ
-আমি ভূত না বাজান, আমি হলাম সেই রিকশাওয়ালা। ছদ্দবেশী ভূত।
-ওঃ আপনি তাহলে সেই ভূত, তো আপনি এতোকিছু জানলেন কিভাবে?
-কোথায় কি জানলাম আসার পথে যে কয়টা প্রশ্ন করে যা যেনেছি তাই বলে দিলাম। তাহলে বুঝতে পারছো...
-আপনি প্রকৌশলীর কথা’টা কিভাবে জানলেন।
মানুষকে দেখলেই অনুমান করা যায়, তোমার ব্যাগে বই।
-আপনার তো অনেক বুদ্ধি, ভালো করে পড়ালেখা করলেই একজন বড় গবেষক হতে পারতেন...
আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা চাচা একটু অনুতপ্ত হলো, চোখের পানি মুছে বললো যা হবার হয়েছে। নিজের ভাগ্যে আগেই ফাটাবাশ জোটাইছি, এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। শত হলেও তো আর শিক্ষা জীবনে ফিরে যেতে পারবো না।
আমি বললামঃ
-চাচা আপনি আমার জীবনটা আজ বাচালেন। কিভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই যা ভাষায় খুজে পাচ্ছি না।
-চলো এখন এখানে আর থেকো না। তোমরা তো নিজের ভূলটা বুঝতে পেরেছো তাতেই আমার আজকের সফলতা। তোমরা বাড়িতে গেলে অবস্যই এই চাচা’রে মনে রাখিও......
-চাচা আপনার নাম’টাই তো জানা হলো না;
আমার নাম, আমার নাম মতিন মিয়া। তোমাদের নাম বলো এখন
-আমার নাম _____, আর আমার প্রিয় মানুষ’টার নাম_______।
আমি আর আমার প্রিয় মানুষটা সহ গেলাম তাদের বাসায়। তারা আমাদের আত্মীয়ের মতো দেখলো। এবং সকালে বাসে তুলে দিলো। আমরা আসলাম রংপুরে। বুঝতে পেলাম নিজের ভূল জানিনা বাসায় এখন কি হবে...
.
শেষ কথা
আজ বাসায় কিছুটা ভিড় ভিড় লাগতেছে। দুজনের পরিবার আমাদের বাসায়। আমার প্রিয় মানুষটার বাবা/মা আমার বাবা/মা। এতো বড় একটা ভূল সিদ্ধান্ত নিতে ধরেও বাবা/মা আমাদের ক্ষমা করে দিবে ভাবতেও পারিনি। আমাদের তো ধরে বেধে মেরে তকতা বানানো উচি। কিন্তু তারা তা করলো না। বরং শান্তনা দিতে লাগলো। আমার মা বললোঃ
‘তুমি নিজের ভূল বুঝতে পেরেছো তাতেই আমরা খুশি, তোমার বিয়ের বয়স হলে তোমার প্রিয় মানুষ’টার সাথেই তোমার বিয়ে দেয়া হবে।'
এদিকে আবার আমাদের নিয়ে পত্রিকায় শিরোনামও বেড়িয়ে এসেছে। শিরোনামটা এরকম...
“ভূল সিদ্ধান্তের হাত থেকে রক্ষা পেলও যুবক/যুবতি”
আবার আরেকটা পত্রিকার শিরোনাম
“ভূল সিদ্ধান্ত”
*****
⇨ এই গল্পের লেখকের চরিত্র'টি কাল্পনিক হলেও রিকশাওয়ালা'র চরিত্রের মদ্ধ্যে একটি সত্যঘটনা লুকিয়ে আছে, তার বলা গল্পটাই। যা পুরোটাই সত্য। এমনটা ঘটেছে একটা ছেলের জীবনে, সেই পৃক্ষাপটে এই গল্পটা লেখা।
আমি সবে দশম শ্রেনীতে পড়ি। ছাত্র হিসেবে খারাপ না, বরং ভালো। ক্লাসে প্রথম হতে না পাড়লেও দ্বিতীয় তৃতীয়’তে সর্বদাই আমার স্থান থাকে। আমার একজন খুব প্রিয় মানুষ আছে। সে আমার এক ক্লাস নিচে পড়ে, মানে নবম শ্রেণীতে। আমরা দু’জন দুজন’কে অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমার প্রিয় মানুষটা আবার অনেক মেধাবী। মুখস্থ বিদ্যায় পটু। সায়েন্সের স্টুডেন্টরা সাধারণত একটু মেধাবী হয়। আমিও অবস্য সায়েন্সের ছাত্র। মেয়েরা মেধাবী হওয়ার কারণ হলো, তাদের শুষ্ক মস্তিষ্কে খুব সহজেই মনে রাখতে পারে অনেক কিছু। কাজ টাজ না থাকায় যখন তখন বইয়ের গভিরে ডুবে যেতে পারে।
আমার কথা আর কী বলবো। আমি’তো বইখোর সারাক্ষণ নানান সব বই নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু ইদানিং আমাদের দুজনের মদ্ধে যেনো একটা পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে। সারাক্ষণ হারানোর ভয়টা মনের মদ্ধে গেথে যাচ্ছে। অনেক আবেগে জড়িয়ে পড়েছি আমরা। একদিন রাত্রে আমার সাবকনসাসমাইন্ড যেনো সারাক্ষণ ভাবাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিয়ে করে ফেলি। বুঝতেই পারছেন বিয়ে করতে হলে কিভাবে বিয়েটা করতে হবে। এই বয়সে তো আর দু’জনের পরিবার কখনোই রাজি হবে না। নাঃ বরং একবার বাবা/মা’কে বলে দেখলে মন্দ হবে না হয়তো। মা’কে বললাম ‘
'মা আমি বিয়ে করবো’
মা বললো,
'দিবো এক কসি থাপ্পর। পাগল হয়েছিস নাকি, এটা তোর পড়ালেখার বয়স। বিয়ের বয়স নয়। যা ভাগ এখান থেকে। যে পিচ্চি বাচ্চা, বলে নাকি বিয়ে করবে আবার।'
আমি পড়ি দশম শ্রেণীতে, এখনো নাকি আমি পিচ্চিই রয়ে গেছি মায়ের কাছে। নাঃ বুঝতে পেরেছি, এভাবে কাজ হবে না। পালিয়ে বিয়ে করতে হবে। এটাই ভালো হবে আমাদের দুজনের জন্য।
আজকে আমি অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠেছি। ফজরের নামাজ পড়ে আর কোনো পড়তে বসিনি। বরং আজ ভোরে হাটছি। হাটলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। আজকের সকালটা আমাকে অনেক শান্ত লাগতেছে। স্কুল, সকাল সাতটায় যাইতে হয়, তাই আজ আর হাঁটা হলো না। বাড়িতে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সোজা স্কুলে রওয়ানা দিলাম।
আজকে আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। ক্লাসের মদ্ধে খুবই বিরক্ত লেগেছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো আজ আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা হয়নি। সে নাকি আজ স্কুলেই আসেন।
২
- 'স্যার আসতে পারি?'
- না, তুই ওখানে দাড় হয়ে থাক। আজ তুই আমার ক্লাস করতে পারবি না।
- কেনো স্যার?
- ঘড়িতে দেখতো ক’টা বাজে।
- স্যার মাত্র আট’টায় ত্রিশ।
- দিবো এক কসি থাপ্পর, আটটায় ত্রিশ এটা আবার মাত্র। কতক্ষণ আজ লেট করে এসেছিস?
- ত্রিশ মিনিট স্যার
- বাকি দশ মিনিট ওখানে কান ধরে থাক।
স্যারের হুকুম। না মেনে উপায় নেই। সুতরাং মানতেই হচ্ছে। ক্লাসের মদ্ধ্যে সকলের সামনে কান ধরে থাকলাম পুরো দশ মিনিট। আমি চাইলেই অজুহাত দেখাতে পারতাম। কিন্তু তা করলাম না। এমনিতেই তেই মনটন ভালো না। মানুষের হাত হলো মূলত দু’টা। অজুহাত ও মূলহাত। এটি একটি কথার কথা মাত্র।
*****
স্কুল ছুটি হলো ঠিক একটায় বিশ মিনিট। আমি তো ছুটি হওয়া মাত্রই রওয়ানা দিলাম আমার প্রিয় মানুষটার কাছে তার স্কুলে। ভাগ্যিস আজ সে স্কুলে এসেছে। তারসাথে দেখা হলো স্কুল ক্যাম্পাসে। আমি পিছন থেকে গিয়ে ‘কুয়ু’ করে উঠলাম। সাথে সাথে চমকে উঠলো সে।
আমার প্রিয় মানুষটা বললো,
- এই তুমি তো আমায় চমকে দিছিলা। এভাবে কেউ কুয়ু করে। তুমি কি কুকিল পাখি নাকি যে কুয়ু করবে।
আমি বললা,
- মনে করো আমি তোমার কুকিল পাখি। আচ্ছা এখন বলো তুমি কেমন আছ?
- আমি ভালোই আছি, তুমি কেমন আছো।
- আলহামদুলিল্লাহ আমিও মোটামুটি। তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
- বলো, তবে তাড়াতাড়ি। এখুনি আমার নানা আসবে।
- আচ্ছা আমরা দু’জন যদি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি তাহলে কেমন হয় বল তো।
- পালিয়ে বিয়ে করবে। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমি বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে করবো। সবাই আনন্দ করবে। আহ! কি মজা হবে।
- তুমি জানো আমি তোমার জন্য অনেক চিন্তিত। সারাক্ষণ শুধু তোমার চিন্তায় কিছুই করতে পারি না। তোমাকে হারানোর ভয়টা মনের মদ্ধ্যে গেথে যাচ্ছে।
- তাহলে তুমি কি এখন চাচ্ছ আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। যদি ভালো হয় তাহলে তাই কর। কিন্তু যা করার ভেবে চিনতে করবে। পড়ে যেনো সমস্যায় পড়তে না হয়। আচ্ছা আমরা যদি পালিয়ে যাই, তাহলে তো আমাদের টাকার প্রয়োজন হবে। সেটা কিভাবে যোগাবে।
- সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি কিছু টাকা এতোমদ্ধেই জমিয়ে রেখেছি।
- আচ্ছা তাহলে আমি এখন বাসায় যাই, চিন্তা করতেছে হয়তো সবাই।
- ঠিক আছে যাও, আমি তোমাকে জানাবো।
আমি ভাবতেও পারিনি যে আমার প্রিয় মানুষটা এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। যাক বাবা বাচা গেলো এখন আমাকে একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে হবে যেটা আমাদের জন্য পালিয়ে যাওয়ার হবে উত্তম একটি দিন।
৩
আচ্ছা আসলেই কি পালিয়ে বিয়ে করাটা উচিৎ হবে। একটু ভেবে দেখা উচিৎ ছিলো। পরবর্তীতে কি হবে? নাঃ অতো ভাবা টাবার সময় নেই, যা হবার হবে। পরে দেখা যাবে সেটা।
দিন ঠিক করলাম। ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস। এই দিনটাতে আমাদের দুজনের স্কুল বন্ধ থাকবে। তবে স্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। আমরাও এই ফাকে পালিয়ে যাবো এই দিনটাতেই দুজনে।
স্কুল ছুটি হলো। আমি আমার প্রিয় মানুষটার সাথে দেখা করলাম আর আমার সমস্থ প্লান খুলে বললাম।
আমি বললাম;
- শুনো আমরা ২৬শে মার্চ পালিয়ে যাবো বিয়ে করতে তুমি ওই দিন তোমার কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরে নিয়ে আসবে স্কুলে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো স্কুল ক্যাম্পাসে। বুঝেছো...
- ঠিক আছে। আচ্ছা তুমি পালিয়ে যাওয়ার জন্য ২৬শে মার্চকে কেনো বেচে নিলে?
- ওমা! তুমি জানো না, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। মনে করো আমি আমাদের ভালোবাসার স্বাধীনতার ঘোষণা দিলাম। ওই দিন আমাদের স্কুলের ক্লাস বন্ধ থাকবে। তুমি স্কুলের কথা বলে আসবে। ভুলেও স্কুল ড্রেস পড়ে আসবে না।
- তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। এতো বুদ্ধিদীপ্ত মাথা নিয়ে থাকো, আগে বলোনি তো।
- আচ্ছা তুমি এখন যাও। রেডি থেকো কিন্তু। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো।
ডিসিশন ফাইনাল, বিয়েটা তাহলে পালিয়েই হচ্ছে। তাও আগামী ২৬শে মার্চে। নিশ্চিত আমাদের বিজয় হবেই। আমরা এই বিয়েতে বিজয়ী হবোই। মনের মদ্ধ্যে যেনো ছন্দের আবির্ভাব ঘটে গেলোঃ
পালিয়ে করবো বিয়ে
কষ্ট যাবে দূরে
থাকবো না আর একলা ঘরে
সাথে থাকবো দুজন মিলে
থাকবো মোরা সুখে
নাঃ আর কালক্ষেপন করা যাবে না। হাতে আছে দু’দিন, এই দুদিনে সব কিছু ঠিক করতে হবে। পালিয়ে গিয়ে থাকবো কোথায়, তা তো এখনও ঠিক করাই হলো না। টাকার চিন্তা তো বাদই দিলাম, হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে মনে হলো আগে কাজি অফিসে বিয়ে করব, তারপর ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে উঠবো। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ধরে নিলাম এটা একটা এডভেঞ্জার, লং এডভেঞ্জার।
৪
দু'দিন কেটে গেলো। আজকে আমার অনেক খুশি খুশি লাগতেছে। কারণ আজ ২৬শে মার্চ। একদিকে স্বাধীনতা দিবস, আর আমাদের জন্য পালিয়ে যাওয়া দিবস।
আমি ব্যাগ গুছিয়ে প্রয়োজনীয় যা কিছু লাগে সব নিলাম, সাথে কিছু হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটা বইও নিলাম। আমার আবার বই পড়ার নেশা অনেক। বইপোকা বলা যায়, কিন্তু আমি নিজেকে বইপোকা বলি না, বলি বইখোর।
মা’কে স্কুলের কথা বলেই রওয়ানা দিলাম স্কুলে। কিন্তু আমি আমার নিজের স্কুলে না গিয়ে গেলাম আমার প্রিয় মানুষটার স্কুলে। পায়ে হেটে যেতে সময় লাগলো মাত্র দশ মিনিট। আমাদের দু’জনের দেখা হলো স্কুলের ক্যাম্পাসে। আমার প্রিয় মানুষটা ব্যাগ ভর্তি করে ফেলেছে। জানিনা কিভাবে এতোকিছু ম্যানেজ করলো। কিছু টাকাও নিয়ে এসেছে পাচ-ছ’শত টাকা জমানো ছিলো তাই নিয়ে এসেছে আমার প্রিয় মানুষটা। এসেই আমার হাতে ধরে দিলো টাকাগুলো।
আমি বললামঃ
- এতো দেরি হলো যে আসতে?
- দেরি হবে না মানে, অনেক কষ্টে এসেছি। কাপড়-চোপড় খুজতে সময় লাগবে না বলো। এখন বলো তুমি কি পরিকল্পনা করলে।
- আমরা আগে বিয়ে করবো, আর বিয়েটা ঢাকায় গিয়ে করবো। তারপর ঘুরতে যাবো।
- কোথায়?
- শ্রীমঙ্গলে।
- এতো টাকা আছে তোমার কাছে?
- হু আছে, আমি জোগাড় করেছি। আজ সন্ধায় বাসে উঠবো আমরা। এখন বাজে তিনটা। ছ’টায় বাস ছাড়বে ঢাকার উদ্যেশে। আর মাত্র তিন ঘন্টা।
আমাদের এখন তো কোনো মতেই এই তিন ঘন্টা কাটাতে হবে। তাই স্কুলের অনুষ্ঠানেই থেকে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলো চার’টায় ত্রিশ মিনিটে। এরই মধ্যে কেটে গেলো এক ঘন্টা ত্রিশ মিনিট। সারে চারটা পর্যন্ত স্কুলেই থেকে গেলাম। অবশেষে পাঁচটায় ত্রিশ মিনিটে বাস স্থানে রওয়ানা দিলাম। এই মূহুর্তে আমার পেটের মদ্ধ্যে ঢোল বাজানী শুরু হয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি আমাদের কোনো পরিচিত মানুষ দেখে ফেলে। ভয়ে ভয়ে অনেক কষ্টে বাস স্টপে পৌছে গেলাম।
বাস ছেড়ে দিলো কাটায় কাটায় ছয়’টায়। অবশেষে সস্থি পেলাম। আর কোনো চিন্তা থাকলো না। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। কিছুক্ষনের মদ্ধ্যেই দুজনের চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো। ডুবে গেলাম গভির নিদ্রায়।
ঘুম থেকে উঠে ঘড়িতে দেখি বাজে রাত একটা। ছ’ঘন্টা ঘুম হলো বাসের মদ্ধ্যেই বাস ঢাকা জেলায় প্রবেশ করেছে। হয়তোবা আধঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌছে যাবো আমাদের গন্তব্যস্থানে।
****
৫
অবশেষে তাই হলো কেটে গেলো পয়তাল্লিশ মিনিট। পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় বাস ব্রেক কসলো। মানে আমরা পৌছে গেছি ঢাকায়। অবশ এতো বড় ঢাকার কিছুই চেনা নেই আমার। আমি ডেকে তুললাম আমার প্রিয় মানুষটাকে। নেমে পড়লাম বাস থেকে। এখন অনেক রাত। এতো রাত্রে আশা করিনি যে কোনো রিকশা কিংবা অটো পাবো।
-এই ভাই বনানী যাবেন?
-হ যামু, দুইজন জাইবেন নাকি?
-হু, ভাড়া কত দিতে হবে?
-পঞ্চাশ ট্যাহা। অনেক রাইত অইছে তো হেইল লাইগা একটু বেশি। না অইলেও ত্রিশ মিনিটের রাস্তা।
কোনো কথা না বলে আমরা দুজন উঠে পড়লাম। রিকশাওয়ালাকে দেখে বেশ ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। বয়স আনুমানিক চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ হবে। রিকশাওয়ালা বললোঃ
-আপনেরা কোনেত্তে আইছেন?
-আপনে জেনে কি করবেন।
-না মানে, এমনি কইলাম।
আমার প্রিয় মানুষটা বললো
-চাচা আমরা রংপুর থেকে এসেছি।
-এইহানে কি তোমাগো কোন আত্তীয়ের বাড়ি আছে?
আমি বললামঃ
-Why Are You Tell Lot Of Question? (আমি রেগেমেগে বললাম)
আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে বললোঃ
-তুমি আবারো ইংরেজি বলতেছো মানে, তোমাকে না বলেছি ইংরেজি কম বলতে।
-দুঃখিত। মুখ ফুসকে বেড়িয়ে এসেছে
আমার উপর আবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আমি কোনো ইংরেজি বলতে পারবো না আমার প্রিয় মানুষটার সামনে। আমি শেষ পর্যন্ত রিকশাওয়ালাকে বলেই ফেললামঃ
-আমরা বিয়ে করতে এসেছি। বুঝতেই পারছেন পালিয়ে বিয়ে।
-ও’ বুঝেছি, আইচ্ছা তোমাগো একটা গল্প কই শুনবে? আমার জীবনের গল্প।
-এই মূহুর্তে আপনার গল্প টল্প শোনার আমাদের কাছে টাইম নাই, আপনি আমাদের দ্রুত নিয়ে যান। রাত অনেক। আর শুনেন কোনো একটা কাজি অফিসের বাড়িতে নেমে দিয়েন। (কড়াভাবে বললাম)
-যে আইচ্ছা (বলেই রিকশাওয়ালা চুপচাপ থাকল)
মধ্যরাত। রাস্তায় শুধু আমাদের রিকশাটা ছাড়া অন্য কোনো রিকশা চোখে পড়ে না। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত পুরো রাস্তাটা। হালকা বাতাস ভেষে আসছে। শীতল করে দিচ্ছে পুরো শরীর। এই সময়টাতে ঠান্ডা গরম কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হালকা ঠান্ডা বললে ভুল হবে না হয়তো।
হঠাত করে রিকশা থামলো। মনে হয় আমরা এসে গেছি। এই মূহুর্তে যে জায়গায় রিকশাটা থেমেছে সেখানে আশপাশ কোনো বাড়ি চোখে পড়ে না। তবে সামনে একটা দু’টা পুরোনো বাড়ি রয়েছে। হয়তো সেগুলো এখন ব্যবহত হয় না। তবে চাদের আলোয় বাড়িগুলো বেশ দেখাচ্ছে। রিকশাওয়ালা বললোঃ
-বাবা তোমরা এইহান থাহো আমি এহুনি আইতাছি।
-কোথায় যাবেন আপনি? আমাদের এই ভুতুড়ে যায়গায় রেখে।
-এক এর চাপ দিছে, এক করতে যাচ্ছি। এহুনি আইমু।
-আচ্ছা যান, তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু।
ভাবলাম কি আর হইলো কি। লোকটা এক এর কথা বলে যে কোথায় উধাও হয়ে গেলো রিকশা সহ আমাদের এখানে রেখে। এখনো আসতেছে না।
৬
এতোমদ্ধ্যে পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়ে গেলো, এখনো রিকশাওয়ালার কোনো খোজই নেই। এক করতে তো এতো সময় লাগার কথা না। বুঝেছি! এই শালায় আমাদের এই ভূতুড়ে পরিবেশে রেখে পালাইছে। শালা রিকশা’র হেডলাইট টাও জ্বালায় রাখে নি।
হঠাত করে আমার প্রিয় মানুষটা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো, বললো;
-“আমার খুব ভয় করতেছে।
আমি বললামঃ
-“কোনো ভয় নেই, তুমি কোনো চিন্তা করো না’তো। আমার হাত ধরে থাকো।
এতোমদ্ধ্যে আমারো ভয় লাগতে শুরু করেছে। গভির রাত, হালকা চাদের আলো। কোথাও কেউ নেই। একদম অপরিচিত একটা জায়গা। যদি কিছু ঘটে যায় আবার। দেশে তো আবার ডাকাত, অসৎ মানুষের অভাব নেই। এখন আমার বুকের মদ্ধ্যে অসস্থির ভাব চলে এসেছে। ভয় লাগতে শুরু হয়েছে।
হঠাত করে পাশের একটা পুরোনো বাড়ি থেকে কী জেনো শব্দ করলো। শব্দ করার সাথে সাথে আমার প্রিয় মানুষটা ওরে বাবা ভূত বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হয়তোবা ভয় পেয়েছে। মেয়েরা সাধারণত অল্প কিছুতেই ভয় পেয়ে যায়।
বাড়িটা আনুমানিক একশত-দু’শত বছরের পুরোনো হবে হয়তো। আমিও মনে মনে ভয় করলাম একটু। কিন্তু তা প্রকাশ করলাম না। আমার প্রিয় মানুষটার মতে কোনো ভুত টুত হবে হয়তো। আমি আবার ওসব ভূত-টুত বিশ্বাস করি না।
ভূত সম্পর্কে আমার জীবনের একটা গল্প বলা যাক। একবার আমি আমার ভাই সহ শ্রীমঙ্গলে যাই, শ্রীমঙ্গলে আমার ভাইয়ের শশুর বাড়ি। আমার ভাইয়ের শালীর বিয়ের দিন ভাইয়ের নিজের শালা বউকে ও তার নিজের শালীকে নিয়ে আসে চট্রগ্রাম থেকে। বিয়ের দ্বিতীয় দিন ভাইয়ের শশুর বাড়িতে থাকার যথেষ্ঠ পরিমানে যায়গা না থাকায় তার শালা বউকে ও তার ছোট শালীকে নিয়ে আমার ভাবির বোনের বাড়িতে যায় থাকতে। সেই রাতেই ঘটে যায় ভূতুরে কাহিনি। আমার ভাইয়ের শালার শালীকে নাকী ভূতে ভর করেছে। কারণ সে আবল-তাবল বলতে শুরু করেছে, রাত তখন অনেক হয়েছিল । আনুমানিক বাড়টা বেজে গিয়েছিল। এ বাড়ি থেকে আমরা খবর পেয়ে ছুটে যাই, আমাকে তো নিতেই চায় না। আমি ছোটো মানুষ বলে। তবে নিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কানে তেল মেখে। যে ভূত ভর করেছে সে ভূত আর যে সে ভূত নয়, স্বয়ং আমার ভাইয়ের বড় শালীর স্বামীর আত্মা। আমার ভাইয়ের শালীর স্বামী একটি রহস্যময় কারণে মারা যায়, তা না বলাই ভালো। সবাই রাত্রে ঘুমাতে পারবে না হয়তো।
আমি ভাইয়ের শালার স্ত্রীর কথা শুনে হতবাক। তার বোনকে নাকি আত্মা ভর করেছে। তার বোনের বয়স আনুমানিক আট-নয় হবে। নাম মিনারা, বেশ সুন্দর নাম। আমি বললামঃ
-আত্মা বলতে কিছু আছে নাকী। এসব ভূত টুত বলতে কিছু নেই। আছে শুধু জিন, পরী, কিন্তু ভূত নয়।
-ভূত নেই, একদিন রাত্রে এই গ্রামের বাথরুমে ডুবে দিবো তখন বুঝবা ভূত কেমন নেই।
ভাইয়ের শালার স্ত্রীর কথা শুনে আমার নিজের অজান্তেই হাসি চলে এলো।
রাত অনেক। তাই না ফিরে ওখানেই থেকে গেলাম আমরা কয়েকজন। আমার ভাই, তাওয়াই, আমি আর কয়েকজন মিলে মাটির বাড়িতে থেকে গেলাম। শোয়া মাত্র আমার চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো, মানে রাজ্যের ঘুম আমার শুরু হয়ে গেলো। সেই রাত্রে আমি এমন সপ্ন দেখেছি যা আমাকে বিশ্বাস করতে বাদ্ধ করেছে যে এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। সপ্নটা দেখার পর আমি আর ঘুমাতে পারিনি। খুবই ভয় পেয়েছিলাম। ফজরের আজানের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। সপ্নটা অনেক ভয়ের ছিলো। তোমাদের বললে হয়তো ঘুমাতেই ভয় পাবে। তাই বললাম না। অবস্য সপ্নের কথা না বলাই ভালো।
আমার ভাইয়ের শশুর একজন ঈমানদার মানুষ। তিনি কিছু নির্দিষ্ট দোয়া দরুদ পড়ে ফু দিয়েছেন। সাথে সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তার মতে এই বাড়িতে কিছু জীন/পরী দখল করার চেষ্টা করতেছিলো। কারণ কয়েকদিন ধরে বাড়িটা ফাকা ছিলো। পাশেই হিন্দু পল্লি। তবে একদিকে হিন্দু আরেকদিকে মুসলিম। চা বাগানে ভরপুর, পাহাড়ী চা, রাবার বাগান, বিশাল বন, বানরের কোনো অভাব নেই। গ্রামের নাম দূর্গানগর।
তার মেয়ের বিয়ের কারণে এই বাড়ির সবাই শশুর বাড়িতে ছিলো। আমারও তাই ধারণা। এটাই হবে মূল কারণ। ভূত বলতে কিছু নেই। শুধুমাত্র জিন পরিরাই আছে। যা আল-কুরআনেও উল্লেখ আছে। পৃথিবী বড়ই অদ্ভুত।
*****
৭
আমার প্রিয় মানুষটা সত্যি অনেক ভয় পেয়ে গেছে। হঠাত করে সেই পুরোনো বাড়ি থেকে একটা কন্ঠ ভেষে এলো। কন্ঠটা অনেকটা মানুষের মতো। কিন্তু বেশ ভয়ংকর।
-কে হে বতস তোরা, এদিকে আয়।
আহ ভূত আবার এতো শান্ত ভাবে কথা বলে। আমি হতবাক, বুকে ভয় তো আছেই। আমি বললামঃ
-কে আপনি, ভূত?
-হু, আমি একজন আত্মা। হা হা হা আমি সবার মনের কথা বলতে পারি। আমার অনেক ক্ষমতা।
-তা হলে বলেন তো আমাদের মনের কথা কী?
-তোমরা দুজন সেই রংপুর থেকে এসেছ পালিয়ে বিয়ে করতে, তাই না?
-হু, একদম ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন। এটা ক্যামনে সম্ভব।
-ওই যে বললাম না, আমরা ভূতেরা সব কিছুই জানি। তুমি যে ভূত বিশ্বাস কর না তাও জানি।
.
আমার প্রিয় মানুষটা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখছে, মনে হচ্ছে খুবই ভয় পেয়েছে। সে আমাকে বললোঃ
-আমার খুব ভয় করতেছে। চলো আমরা দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই।
-নাঃ, এই মূহুর্তে পালিয়ে গেলে ভূত বেটায় খেয়ে ফেলবে। তুমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখও। এখন বাজে তিনটা ফজরের আজান হলেই ভূত আর থাকতে পারবে না। এভাবে কথা বলে সময় কাটাতে হবে।
-যদি আমাদের মেরে ফেলে ভূতটা। আহ, অনেক ভয়ংকর ভূতটা।
-তুমি ভয় করো নাতো। ভয় করলে তোমাকে আগে খেয়ে ফেলবে।
ভূতটা আবার বলে উঠলোঃ
-কি বলছ তোরা ফিসফিস করে, আমি কিন্তু সব শুনছি। বলবো?
-না, প্লিজ বলবেন না এগুলো।
-এবার শুনো তাহলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে, আমি তোমাদের আমার জীবনের একটা দুঃখের গল্প বলব। শুনবে তো?
এই ব্যাটা আবার গল্প বলবে। ভূতের জীবনের কী কখনো গল্প হয়, তাও দুঃখের গল্প। আমি বললামঃ
-আচ্ছা বলেন আমরা দুজন শুনতেছি। একটা বড় গল্প বলবেন যেনো এক ঘন্টা লাগে শেষ হতে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে মনোযোগ দিয়ে শুনোঃ
তোমাদের মতো আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি একটা ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যার ফল এখন ভুগতেছি।
আমি বললামঃ
-আপনি আবার ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
-জী, আমিও একবার ভূল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যখন আমি ছোট ছিলাম।
-আপনি না ভূত, আপনি আবার ছোট ছিলেন।
-আমি যখন মানুষ ছিলাম তখনকার কথা বলতেছি, -এখন কোনো কথা না বইলা মনোযোগ দিয়ে শুনো।
-জী, আচ্ছা।
ভূতটা তার জীবনের গল্প শুরু করলো, তিনি বলতে লাগলেনঃ
আমি যখন দশম শ্রেনীতে উঠি তখন সপ্তম শ্রেনীর এক মেয়ের সাথে আমার ভালোলাগা শুরু হয়, অতঃপর ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। আমি ছাত্র হিসেবে কখনোই ভালো ছিলাম না। টেনে টুনে পাস করতে পারলেই আমি যেনো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। কোনো মতো পাস করাটাই ছিলো আমার অভ্যাস। আমি সারাক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম, ঘুড়ে বেড়াতাম। স্কুল টাইমে স্কুলে যেতাম লেট করে, বন্ধুদের সাথে লাস্ট বেঞ্জে বসতাম, গল্প করতাম, স্যার পড়া ধরলে পারতাম না। সারাক্ষণ স্টাইল নিয়ে বেড়াতাম। সাধারণত Smart আমরা বলি তাদের যারা ভালো পোষাক পড়ে, বিএমডব্লিউ নিয়ে ঘুড়ে। ক্লাসের সময় লাস্ট বেঞ্জে বসে, স্যার পড়া ধরলে পড়তে পারে না। এটাকেই আমরা মূলত স্মার্টনেস বলি। প্রকৃত পক্ষে এটা Smart নয় বরং বখাটে। কেনোনা Smart এর এটা প্রকেত অর্থ নয়। Smart এর পূর্ণ রুপই হলো S=Specific M=Measurable A=Achievable R=Realistic T=Timeframe.
যারা কোনো কিছু শেখার চেষ্টা করে, সময়মত কাজ সম্পূর্ণ করে। যাদের সময় ব্যবহার করতে পারে না। তারাই প্রকেত পক্ষে Smart. সময়কে ব্যবহার করতে না পারলে সময় বরং আমাদের ব্যবহার করবে।
যাইহোক, আমি আর আমার প্রেমিকা মিলে সিদ্ধান্ত নেই পালিয়ে যাওয়ার। ঠিক তোমাদের মতো, তবে একটু ভিন্ন। এবং সময় নির্ধারণ করে পালিয়ে যাই। যদিও সামনে ছিলো এসএসসি পরিক্ষা। কিন্তু সে টেনশন আমার একদমই ছিলো না। ব্যাপার না, হয়ে যাবে। অর্থাৎ খাও দাও ফূর্তি করো, জীবন’টা মস্তবড়। আমরা পালিয়ে যাই, কিন্তু রাত্রে আবার বাদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে হয়। তবে কয়েকদিন পর আবারো আমরা একই কাজ করে ফেলি, তাতেও ফিরে আসতে হয়, কারণ কোন কাজিই আমাদের বিয়ে পড়াতে চাইছিল না। কেউ রিস্ক নিতে চান না। এরপর বাদ্ধ হয়ে আমার পিতা মাতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তাছাড়া যে আর কিছুই করার ছিল না। অল্প বয়সে বিয়ে, বুঝতে পারছো বাল্য বিবাহ। ছেলে এসএসসি এখনো দেয় নি, আর মেয়ে কেবলে সপ্তম পড়ে। তেরো থেকে ষোল বছর।
কিন্তু একদিন যেনো নেমে এলো এক অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন। অন্ধকারাচ্ছন্ন বলতে বিপদময়। যা খুবই কান্নাদায়ক। বলেই ঢুকরে ঢুকরে কানতে লাগলো ভূতটি। আমি বললাম,
-কি জন্য দিনটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো বলবেন কি একটু।
ভূতটা বললোঃ
-আমার বাবার মৃত্যু হয় ওই দিন, আমার বাবা তখনো ছেলে মানুষ, বয়স আনুমানিক চল্লিশ-পয়তাল্লিশ। হয়তবা আমার চিন্তাই তার মৃত্যুর আসল কারণ। হয়তোবা নয় বরং হয়েই। সারাদিন যেনো আর আমার কান্না কেউ থামাতে পারে না। খনিকের সুখের জন্য সম্পূর্ণ জীবনটাই যেনো বিষন্নতায় এবং এক কঠিন বিপদে ফেলে দিলাম। এ ভূল সিদ্ধান্তটা মোটেও ছোট-খাট নয়, বরং অনেক বড় ভূল সিদ্ধান্ত। এ বয়সে আমাকে কে কাজ দিবে, আমার তো সে যোগ্যতাও নেই। যার ফলে শেষমেশ আমাকে রিকশা চালাইয়া খাইতে হচ্ছে। আমি এখন এক রিকশাওয়ালা।
হায়রে আমি যদি আজ ঠিকমতো পড়ালেখা করতাম তাহলে এমনটা হত না। আমি পড়ালেখায় দূর্বল ছিলাম কারণ আমি ভালো করে পড়ালেখা করি নাই। আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে সুস্থ সবল মস্তিষ্ক দিয়েছে, কিন্তু আমি তার যথাযথ ব্যবহার করি নাই। আমি সবসময় ভেবেছিলাম আমার দ্বারায় এসব পড়ালেখা হবে না। আল্লাহ্ তায়ালার এতো মহান সৃষ্টি’কে তুচ্ছ ভেবেছি, আমি বড় পাপ করেছি। যার ফল এখনো আমাকে ভুগতে হচ্ছে।
অনূরুপ তোমরাও যদি একই ভূল সিদ্ধান্ত নাও তাহলে কিন্তু তোমাদেরও ভব্যিষতে এক কঠিন পরিস্থিতে পড়তে হবে। আমি জানি তোমাদেরও একটা বড় সপ্ন আছে। তোমরাও ভাবো যে ভবিষ্যতে একজন বড় প্রকৌশলী কিংবা বিজ্ঞানী হওয়ার। কিন্তু সেই সপ্নকে যদি বিপর্যয় দাও তাহলে কিন্তু এর থেকে ভয়ংকর আর কিছুই হবে না। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, স্বাধীন হতে চাইতেছো। কিন্তু তোমরা জানও না যে ২৬শে মার্চের পর আরও নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে লাখও মানুষকে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে এই বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি আমরা।
৮
আমরা সত্যি অনেক ভুল করে ফেলেছি পালিয়ে এসে, মোটেও এটা আমাদের করা উচিৎ হয়নি। আমরা দু’জন খুবই ভূল করেছি। আসলেই আমাদের একটা সপ্ন আছে, বড় প্রকৌশলী গবেষক হওয়ার সপ্ন। ওহ, আল্লাহ্ বেচে গেলাম। ভাগ্যিস ভূত চাচা'টা আমাদের বাচিয়ে দিলো। আর কখনোই এরকম ভূল সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমাদের উচিৎ হবে না। এটা ভয়ংকরের চেয়েও ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা করতে গিয়ে সারা জীবনটাই পরাধীন হয়ে থাকতে হতো আমাদের। কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সবসময় ভাবতে হয়, পরে কি হবে।
আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে বললোঃ
-'একদম ঠিক বলেছ তুমি। এখন আমাদের উচিৎ হবে বাসায় চলে যাওয়া। আমরা অনেক বড় ভূলের হাত থেকে বেচে গেলার। যতদিন আমরা প্রতিষ্ঠিত হবও না, ততদিন আমাদের মধ্যে কোনো বিয়ের নাম থাকবে না।'
চতুর্দিকে আজান হচ্ছে, এই মূহুর্তে ভূত চাচা’টা বললোঃ
-তাহলে তোমরা কি এখনি যাবে। বাজান তোমরা বরং আজ আমাদের বাসায় চলো। কাল বরং আমিই তোমাদের পৌছে দিবো বাসস্টানে।
আমি বললামঃ
-আপনি না ভূত। আপনি কিভাবে আমাদের পৌছে দিবেন।
ভূতটা হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এলো, বললোঃ
-আমি ভূত না বাজান, আমি হলাম সেই রিকশাওয়ালা। ছদ্দবেশী ভূত।
-ওঃ আপনি তাহলে সেই ভূত, তো আপনি এতোকিছু জানলেন কিভাবে?
-কোথায় কি জানলাম আসার পথে যে কয়টা প্রশ্ন করে যা যেনেছি তাই বলে দিলাম। তাহলে বুঝতে পারছো...
-আপনি প্রকৌশলীর কথা’টা কিভাবে জানলেন।
মানুষকে দেখলেই অনুমান করা যায়, তোমার ব্যাগে বই।
-আপনার তো অনেক বুদ্ধি, ভালো করে পড়ালেখা করলেই একজন বড় গবেষক হতে পারতেন...
আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা চাচা একটু অনুতপ্ত হলো, চোখের পানি মুছে বললো যা হবার হয়েছে। নিজের ভাগ্যে আগেই ফাটাবাশ জোটাইছি, এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। শত হলেও তো আর শিক্ষা জীবনে ফিরে যেতে পারবো না।
আমি বললামঃ
-চাচা আপনি আমার জীবনটা আজ বাচালেন। কিভাবে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই যা ভাষায় খুজে পাচ্ছি না।
-চলো এখন এখানে আর থেকো না। তোমরা তো নিজের ভূলটা বুঝতে পেরেছো তাতেই আমার আজকের সফলতা। তোমরা বাড়িতে গেলে অবস্যই এই চাচা’রে মনে রাখিও......
-চাচা আপনার নাম’টাই তো জানা হলো না;
আমার নাম, আমার নাম মতিন মিয়া। তোমাদের নাম বলো এখন
-আমার নাম _____, আর আমার প্রিয় মানুষ’টার নাম_______।
আমি আর আমার প্রিয় মানুষটা সহ গেলাম তাদের বাসায়। তারা আমাদের আত্মীয়ের মতো দেখলো। এবং সকালে বাসে তুলে দিলো। আমরা আসলাম রংপুরে। বুঝতে পেলাম নিজের ভূল জানিনা বাসায় এখন কি হবে...
.
শেষ কথা
আজ বাসায় কিছুটা ভিড় ভিড় লাগতেছে। দুজনের পরিবার আমাদের বাসায়। আমার প্রিয় মানুষটার বাবা/মা আমার বাবা/মা। এতো বড় একটা ভূল সিদ্ধান্ত নিতে ধরেও বাবা/মা আমাদের ক্ষমা করে দিবে ভাবতেও পারিনি। আমাদের তো ধরে বেধে মেরে তকতা বানানো উচি। কিন্তু তারা তা করলো না। বরং শান্তনা দিতে লাগলো। আমার মা বললোঃ
‘তুমি নিজের ভূল বুঝতে পেরেছো তাতেই আমরা খুশি, তোমার বিয়ের বয়স হলে তোমার প্রিয় মানুষ’টার সাথেই তোমার বিয়ে দেয়া হবে।'
এদিকে আবার আমাদের নিয়ে পত্রিকায় শিরোনামও বেড়িয়ে এসেছে। শিরোনামটা এরকম...
“ভূল সিদ্ধান্তের হাত থেকে রক্ষা পেলও যুবক/যুবতি”
আবার আরেকটা পত্রিকার শিরোনাম
“ভূল সিদ্ধান্ত”
*****
⇨ এই গল্পের লেখকের চরিত্র'টি কাল্পনিক হলেও রিকশাওয়ালা'র চরিত্রের মদ্ধ্যে একটি সত্যঘটনা লুকিয়ে আছে, তার বলা গল্পটাই। যা পুরোটাই সত্য। এমনটা ঘটেছে একটা ছেলের জীবনে, সেই পৃক্ষাপটে এই গল্পটা লেখা।
COMMENTS